Saturday 20 February 2016

ভারমুক্ত হলো বৃক্ষমানবের ডান হাত














দুটি আঙুল জটমুক্ত করার পরিকল্পনা নিয়ে আজ শনিবার অস্ত্রোপচার কক্ষে ঢুকেছিলেন মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা। সেখানেই চিকিৎসকদের তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে বৃক্ষমানব আবুল বাজনদারের পাঁচটি আঙুল জটমুক্ত হলো।
অস্ত্রোপচার শেষে আবুল বাজনদার হাসি মুখে বললেন, ‘দুর্বল শরীর তো। ভয় লাগছিল। ভালো লাগছে এখন।’
আজ সকাল সোয়া নয়টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত আবুল বাজনদারের অস্ত্রোপচার হয়। ‘ট্রিম্যান সিনড্রোমে’ ভোগা বিশ্বের চতুর্থ রোগী হিসেবে দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক কৌতূহলের জন্ম দেন তিনি।
অস্ত্রোপচার কক্ষ থেকে চিকিৎসকেরা আজ সরাসরি সংবাদ সম্মেলনে এসে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। অস্ত্রোপচারটি তাঁদের ভাষায় ‘যথেষ্ট জটিল’ ছিল। তবে রোগীর হাসি মুখ তাঁদের শঙ্কামুক্ত করেছে।
মেডিকেল বোর্ড এবং বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারির বিভাগীয় প্রধান আবুল কালাম বলেন, ‘চারপাশ থেকে গাছের শেকড়ের বৃদ্ধির কারণে ওর আঙুলগুলো চিহ্নিত করা যাবে কি না তা নিয়ে সংশয় ছিল। পাঁচটি আঙুলই আমরা খুঁজে পেয়েছি। আশার কথা আঙুলগুলোয় স্বাভাবিক রক্ত চলাচল আছে। এটি একটি ভালো লক্ষণ।’
প্রথমে দুটি জটমুক্ত করার কথা থাকলেও, পরে পাঁচটি আঙুলেই অস্ত্রোপচার করা হয়। এ বিষয়ে আবুল কালাম বলেন, ‘বেশ দ্রুতই আমরা দুটি আঙুল খুঁজে পাই। পরে বোর্ডের সবার সম্মতিতে পাঁচটি আঙুলেই অস্ত্রোপচারের তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিই। আপনি যদি সাত দিন হাতে কোনো কাজ না করেন, অষ্টম দিনে হাতটি ঠিকমতো কাজ করবে না। আবুল বাজনদারের হাতটি প্রচণ্ড ভারী হয়েছিল। অকেজো হয়ে পড়েছিল। কিন্তু রক্ত সঞ্চালন থাকায় আমরা আশা করছি, তিনি হয়তো সাধারণ কাজকর্ম করতে পারবেন।’
মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা অস্ত্রোপচারের পুরো প্রক্রিয়ার বর্ণনা দেন। হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে ‘এপিডার্মোডিসপ্লাসিয়া ভেরাসিফরমিস’ বা ‘ট্রি-ম্যান’ (বৃক্ষমানব) সিনড্রোমে আক্রান্ত হন আবুল বাজনদার। এই ভাইরাসের সংক্রমণে ক্যানসার হয়ে থাকে। অস্ত্রোপচারের আগেই ক্যানসার আছে কি না সে পরীক্ষাসহ, প্রয়োজনীয় বাকি সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন চিকিৎসকেরা।
অস্ত্রোপচারের জন্য আজ আবুল বাজনদারকে পুরোপুরি অচেতন করা হয়নি। বোর্ড বলছে, পুরোপুরি অচেতন করা হলে হৃদ্‌যন্ত্র, ফুসফুস ও মস্তিষ্কে বিরূপ প্রভাবের আশঙ্কা থাকে। তাঁর বেলায় শুধু মাত্র ডান হাতটি অবশ করা হয়েছে। ছুরি ব্যবহার না করে চিকিৎসকেরা ইলেকট্রো সার্জারি করেন। এতে অস্ত্রোপচার হয়েছে দ্রুত, রক্তপাত হয়েছে খুবই কম।
ছয় সদস্যের মেডিকেল বোর্ডে আরও তিনজনকে যুক্ত করা হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের সার্জারির বিভাগীয় প্রধান এ বি এম খুরশীদ আলম ও মাইক্রোবায়োলজির প্রধান শহীদুল ইসলাম ছাড়াও দেশের অন্যতম চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ এম ইউ কবীরকেও বোর্ডে যুক্ত করা হয়। এম ইউ কবীর বলেন, ‘আগামী সোমবার আবুল বাজনদারের হাতের ব্যান্ডেজটি খোলার কথা রয়েছে। এরপর আমরা লো লেভেল রাইট থেরাপি দেব। এতে তাঁর হাতে রক্ত চলাচল বাড়বে, ব্যাকটেরিয়া দমন করা সম্ভব হবে, স্নায়ুর কার্যকারিতা ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে।’
পরের অস্ত্রোপচারটির জন্য কমপক্ষে তিন সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হতে পারে বলেও জানান মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা। আবুল কালাম বলেছেন, আবুল বাজনদারের চিকিৎসায় রয়াল মেলবোর্ন হাসপাতাল ও লন্ডন স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের চিকিৎসকদের সঙ্গে তাঁদের নিয়মিত যোগাযোগ আছে।
তবু শঙ্কা: আপাতত ভারমুক্ত হলেও নতুন করে আবুল বাজনদারের হাতে আবারও এমন বৃদ্ধির আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। আবুল বাজনদার যে রোগটিতে ভুগছেন তার উৎপত্তি জিনগত কারণে। ডিএনএ’র ঠিক কোন জায়গাটিতে অসংগতি সেটি ধরতে হলে ‘ডিএনএ ম্যাপিং’ করতে হবে। ডিএনএ ম্যাপিং এর কাজ এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠানে চলছে। ওই প্রতিবেদন হাতে পেতে আরও প্রায় দুই মাস সময় লাগবে। প্রতিবেদন হাতে পেলে আবুল বাজনদারের অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করতে হতে পারে।
পরিবারের সদস্যরা খুশি: পোস্ট অপারেটিভ কক্ষে থাকা আবুল বাজনদারের কাছে দাঁড়িয়ে বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারির জাতীয় সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন কথা বলছিলেন। আবুল বাজনদার হাসি মুখে টুকটাক কথা বলছিল চিকিৎসকদের সঙ্গে। মাথার কাছে তখন দাঁড়িয়ে স্ত্রী ও একমাত্র মেয়েটি।
কথা হয় আবুল বাজনদারের মা আমিনা বেগমের সঙ্গে। এই মায়ের এখন একমাত্র চাওয়া ছেলেকে ফিরে পাওয়া। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘বেশি কথা বলতে দেয়নে। তবে ছেলে ভালো আছে বলিছে। আপনারা সবাই দোয়া করেন, ছেলেটা যেন আমার কোলে ফিরি আসে।’ সন্তুষ্ট আবুল বাজনদারের বাবা মানিক বাজনদারও। দরিদ্র পরিবারের প্রায় পঙ্গু ছেলেটির কোনো দিন চিকিৎসা হবে-সে আশাই ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি

No comments:

Post a Comment